blogger widgets

Monday 24 February 2014

তোমায় ছুঁয়ে দেখবো বলে- প্রথম অধ্যায়

আমি শোভন। থাকি মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়া নিজেদের একতলা বাড়ীতে আমার পরিবারের সাথে। পরিবারে আমি, আমার মা, বাবা, বড় ভাইয়া, সুইট ভাবি আর আমার নটি কিউটি ভাইপো। অনেক বড় ফ্ল্যাটে আমাদের সুখী পরিবার। আমাদের ভাড়াটিয়া হিসেবে পাশের ২ টি ফ্ল্যাটে থাকে আরো দুটি পরিবার। মাজহার আঙ্কেলের পরিবার আর একটি আদিবাসী গারো পরিবার সাংমা আঙ্কেলের পরিবার । আমাদের খুব ভালো প্রতিবেশী ওরা। দেখতে মন্দ ছিলাম না বলে জীবনে মেয়েদের কাছ থেকে কম প্রপোজ পাইনি জীবনে। সেই স্কুল লাইফ থেকেই। 

কিন্তু ছেলেবেলা থেকে আমার মেয়েদের তেমন ভালো লাগতো না। তাই মেয়েরা খুব একটা সুবিধে পায় নি। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফাইনান্স এ বিবিএ করছি। অনেক স্বপ্ন নিজেকে নিয়ে। নিজের ক্যারিয়ার গুছাবো, বাইরে গিয়ে এমবিএ করবো, কখনো সুযোগ পেলে ডক্টরেট করবো আমার বিষয় নিয়ে। খুব একা লাগতো নিজেকে। আমার যে ছেলেদেরকে ভালো লাগতো এই কথাটা কাউকে কখনো বলার সুযোগ পাইনি। ছিলও না কেউ তেমন। তবে ছেলেবেলায় আমার এক স্কুল বন্ধু ছিল, তার নাম মিশু। আজ তোমাদেরকে মিশুর কথা শুনাবো-ক্লাস এইটে উঠার পর আমার বাবা একটা জেলা শহরে বদলি হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও চলে গেলাম। নতুন স্কুলে ট্রান্সফার হয়ে গেলাম। আর সেখানেই আমার সাথে পরিচয় হয় মিশুর। স্কুলে এতো এতো ছেলের থেকে মিশু ছিল সবার থেকে আলাদা। মেয়েলি আচরনের কারনে তার সাথে কেউ সহজে মিশত না। কিন্তু তাঁকে আমার খুব ভালো লাগত। যখন ক্লাসের ছেলেরা তাঁকে হাফ লেডিস বলে খেপাতো তখন সে খুব ভেঙ্গে পরতো, মাথা নিচু করে কাঁদতো। 


ক্লাসের একদম লাস্ট বেঞ্চে বসতো সে সবসময়। আর সেই লাস্ট বেঞ্চে বসতো খুব দুষ্টু দুষ্টু ছেলেরা। তারা বইয়ের মাঝে লুকিয়ে মেয়েদের নগ্ন নগ্ন ছবি আনত আর ক্লাস চলাকালীন সময়ে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে এসব ছবি দেখতো ৫-৬ জন করে। শার্টের উপরের বোতাম খুলে বুক দেখাতো আর এমন ভাব করতো যে তারা বড় কোন পুরুষ মানুষ হয়ে গেছে। টিফিন টাইমে স্কুলের দেয়াল টপকে তারা ধরাতো টপ টেন সিগারেট আর শার্টের কলার উঁচু করে রাখত। মিশুকে এই ৫-৬ তা ছেলে খুব জালাতো। কখনো তার বুকে টিপ দিতো, গালে টিপ দিত , কখনো পাছায় টিপ দিত একা পেলে। আর এটা দেখে ক্লাসের বাকি ছেলেরা হেসে দিত। আমি সবসময় মিশুকে প্রটেক্ট করার চেষ্টা করতাম। ক্লাসের ছেলেদের সাথে মারামারিও করেছি কখনো সখনো শুধু ওর জন্য। স্কুল শেষে আমি আর মিশু মাঝে মাঝে আমাদের স্কুলের কাছের এক পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়িতে চলে যেতাম । সে আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বোবার মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। আমি আদর করে ওর চোখের জল মুছে দিতাম। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ থাকতাম। ওকে নানা কথা বলে হাসানোর চেষ্টা করতাম আর হাসাতাম। ওর হাসি দেখে আমার বুকটা ধুক ধুক করতো। ইচ্ছে করতো ওকে একটু ছুঁয়ে দেখি। একটু চুমু দেই। কিন্তু কখনো সাহস পাইনি । যদি সে কখনো আমাকে অন্য ছেলেদের মত খারাপ ভাবে? যদি আমাদের এই নিখাদ বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যায় এ ভয়ে । ওর মুখটা দেখলে অনেক মায়া লাগতো। এতো মায়াভরা চেহারা, কেউ যদি মনোযোগ দিয়ে একবার তাকাতো হয়তো তার মনের কষ্টটা বুঝতে পারতো। তাঁকে কখনো বলার সুজোগ পাইনি যে আমি তাঁকে ভালবাসি। ভালবাসা কি সেটা কখনো ভালো করে বুঝিনি, আর তখন তো ভালবাসা কাকে বলে সেটা বুঝতামই না। শুধু এইটুকু বুঝতাম যে ওকে একদিন ক্লাসে না দেখলে আমার ভালো লাগতো না, ওর সাথে টিফিন টাইমে সিঙ্গারা সমচা না খেলে ভালো লাগত না। ওর মুখ না দেখলে কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগতো ভেতরটা।


 খুব শরীর খারাপ না থাকলে ও সহজে ক্লাস মিস দিত না। পিছনের বেঞ্চে বসলেও স্যারদের পড়া খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম আর ওকে বুঝাতাম। ওকে শুধু একটা কথাই বলতাম “সব কিছু ভুলে ভালো করে পড়াশোনা কর। আমি তো আছিই তোর পাশে”। ও আমার কথা শুনে মিটমিট করে হাসতো।আর আমি ওকে অপলক দৃষ্টিতে ওর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ইচ্ছে করত ওকে জাপটে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু দেই। ও ক্লাসে আসতো শুধু আমার জন্য। লাস্ট বেঞ্চে আমি ওকে কিনারায় বসিয়ে পাশে আমি বসতাম । কাউকে ওর পাশে ঘেষতে দিতাম না। সবার আগে আমি ক্লাসে চলে যেতাম আর বসতাম সেই লাস্ট বেঞ্চে আর কিনারের সিটটা ওর জন্যে রেখে দিতাম। এভাবেই চলছিল মিশু আর আমার কামহীন প্রেম। আর কিছুদিন পরেই আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা। আমরা তার পরেই ক্লাস নাইনে উঠে যাব। তাই খুব মনোযোগ দিয়ে আমি আর মিশু পড়াশোনা করতে লাগলাম। আমার প্রথম আর দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় ফলাফল খুব একটা খারাপ হয়নি। প্রথম সাময়িকে নবম স্থান অধিকার করেছিলাম আর দ্বিতীয় সাময়িকে একাদশ। যেভাবেই হোক আমাকে এক থেকে দশের মধ্যে থাকতে হবে। কিন্তু চিন্তা ছিল শুধু মিশুকে নিয়ে। জেলা শহরের সেরা স্কুল ছিল বলে এই স্কুলে চান্স পাওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল অনেকে ছেলের কাছে। তাই স্কুলের নিয়ম কানুন খুবই কড়া। প্রিন্সিপাল স্যার আমাদের আগেই বলে দিয়েছিল যে যারা গড়ে ৭০% এর কম নাম্বার পাবে তারা কেউ সাইন্স পরতে পারবে না। যেতে হবে বানিজ্য কিংবা মানবিক শাখায়। মিশুর রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি। প্রথম সাময়িকে ওর গড় নাম্বার ৫৮% আর দ্বিতীয় সাময়িকে ৬৯%।


ও যদি বার্ষিক পরীক্ষায় গড়ে ৮৩% নাম্বার না পায় তবে ও সাইন্স পড়তে পারবে না। ওকে নিয়ে আমার অনেক ভয়। আমি ওকে হারাতে পারবো না। যেভাবেই হোক আমাকে ওর পাশেই বসতে হবে। নাহলে আমি সাইন্সই পড়ব না। ওকে সাধারন বিজ্ঞান, অংক, ইংরেজি খুব ভালোভাবে পড়াতাম নিজেও পড়তাম। নিজের হাতে নোট তৈরি করে ফটোকপি করে ওকে দিতাম। আমার বাসায় ও মাঝে মাঝে আসত। এক্ সাথেই পড়তাম। ওর বাসাতেও মাঝে মধ্যে যেতাম। ওর মা খুব অসুস্থ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। ওর বড় বোন ছিল সংসারে ওর মাকে দেখাশোনার জন্য। আর ওর বাবাটা ছিল মাতাল। অনেক রাতে বাসায় ফিরতো। ওদের সাথে তেমন ভালো করে কথা বলত না। একটা পুরাতন টিনের ২ তালা বাসায় ওরা থাকতো । আর আমার বাবা ছিল থানার ওসি সে জেলা শহরের থানার। তাই আমরা সরকারি বড় বাসায় থাকতাম। মিশু আমাদের বাসায় আসলে আমার বড় ভাই মুচকি হাসত। কিন্তু মিশু তেমন কারো সাথে কথা বলত না। মাথা নিচু করে আমার ঘরে ঢুকত আর মাথা নিচু করেই বের হয়ে যেত। আমার মা ওকে খুব আদর করত। বাসায় এলেই এটা সেটা রেঁধে খাওয়াত। ওর কোন স্যার ছিল না বাসায় পড়ানোর জন্য। তাই আমিই ওকে পড়াতাম যা ক্লাসে পড়তাম আর বাসার হোম টিউটরের কাছে যা পড়তাম। নিজের হাতে রাত ২ টা পর্যন্ত কখনো কখনো জেগে নোট তৈরি করতাম। আর খুব ভোরে অল্প ৩-৪ ঘণ্টা ঘুমিয়ে ক্লাসে চলে যেতাম। সব শুধু মিশুর জন্য। নিজেকেও পড়তে হবে আর যে করেই হোক মিশুকে থাকতে হবে আমার পাশে। ক্লাসের বাকি ছেলেরা খুব হিংসা করতো আমাকে কারন আমি মিশুকেই আমার সব নোটস দেই আর একসাথে পড়ি বলে। অনেকে দুই এক কথা শুনিয়েও দিত। কিন্তু গায়ে মাখতাম না সেগুলো। আমি জানি ক্লাসে আমার একটাও বন্ধু না। সব শুধু আমার নোটস এর জন্যেই কাছে ঘেষতে চায় । 

দেখতে দেখতে বার্ষিক পরীক্ষা এসে গেলো। একের পর এক পরীক্ষা দিতে লাগলাম। বেশ ভালই লাগলো নিজের কাছে। আমি পরীক্ষা দিয়ে বুঝতে পারতাম যে আমি কত নাম্বার পেতে পারি। আমার অনুমানের নাম্বারের সাথে স্যারদের দেয়া নাম্বারে খুব একটা হেরফের হত না। মিশুকে নিয়ে ভয় ছিল খুব। ওর অংক পরীক্ষা, সাধারন বিজ্ঞান আর ইংরেজি পরীক্ষা কেমন হয় এই ভেবে। ও অংক পরীক্ষা ভালই দিয়েছে। আমরা দুইজনে একসাথে অংকের রেজাল্ট মিলাতাম। যেটা মনে হচ্ছে ও অংকে ৯৫-৯৬% নাম্বার পাবে। সাধারণ বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, বাংলা, ইংরেজি বাকি পরীক্ষা গুলাও ভালো হল ওর। আস্তে আস্তে আমাদের ছুটি হয়ে গেলো বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধের। আমরা ঢাকায় চলে এলাম নানু বাড়ীতে বেড়াতে। ঢাকায় অনেক জায়গায় ঘুরলাম আমি, বড় ভাইয়া, আব্বু, আম্মু। আর কদিন পরেই আমাদের বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল দিবে। কিন্তু আমি এতটা টেনশন করতাম না । কারন আমি জানি আমার রেজাল্ট কেমন হবে। মিশুকে নিয়েও টেনশন নেই কারন মিশুর পরীক্ষাও ভালো হয়েছে। ও হয়তো ৮৭-৮৮% নাম্বার পাবে গড়ে। আমরা দুজনেই সাইন্সে পড়তে পারবো। ঢাকায় এসে এতো জায়গায় ঘুরছি, বেরাচ্ছি, এটা ওটা খাচ্ছি কিন্তু আমার কিছুতেই যেন মন নেই। কি যেন একটা নেই। ঐ মায়াবি মুখটি নেই, ঐ মিটিমিটি হাসিটি নেই। আসতে আসতে দিন গড়াতে লাগলো। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল আগামীকাল। আবার আমি আমার মিশুর মুখটি দেখবো। ওকে ছুঁয়ে দেখবো। আর ওকে খুব করে গালটা টেনে বলবো “ তোকে আমি অনেক ভালবাসি রে, মিশু” ।
আমাদের যেতে যেতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। বড় মামা আমাদের নিয়ে যাবে। আমি মিশুর জন্যে একটা গিফট কিনেছিলাম । দুইটা মাথা নাড়ানো টিউনিং ছেলে পুতুল। একটা পুতুল আমি আর একটা পুতুল আমার মিশু। ব্যাগে খুব একটা মোটা কাগজের বক্সে পুতুলটা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। ঝিক ঝিক করে রেলগাড়ী ছুটে চলেছে আর আমি ছুটে চলেছি আমার মিশুর কাছে। জানালার ধারে বসেছি। বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি আর মিশুকে ভাবছি। ওর সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্ত গুলো একে একে চোখে ভেসে বেরাচ্ছে। কখন যে আমরা সেই ছোট্ট শহরটার স্টেশনে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। 

অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুম আসছে না একদম। বার বার মনে হচ্ছে আমি কখন আমার মিশুকে দেখতে পাব। কালকেই তো রেজাল্ট। অনেক মজা করবো একসাথে। নদীর ধারে একসাথে হাতে হাত রেখে হেটে বেড়াবো সেই আগের মত। বিপিন পার্কে বসে আড্ডা দেবো আর সস্তা আইসক্রিম আর ঝালমুরি খাব। সেই পুরানো জমিদার বাড়িটাতে যাব। ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকের হৃদপিণ্ডের প্রতিটা ধুক ধুক আওয়াজের শব্দ গুনে নেবো, ওর শ্বাস প্রশ্বাসের ভাষা বুঝে নেবো। এভাবে ভাবতে ভাবতে রাত গড়িয়ে ফজরের আজান দিয়ে দিল। চারদিক ফর্সা হয়ে হয়ে যাবে আর কিছুক্ষণ বাদে। আমি কোরআন শরীফ পড়তে জানি, নামাজ ও পড়তে জানি। কিন্তু কখনো নিয়মিত পড়ি না। ফজরের নামাজ তো নয়ই। আজ আমি আল্লাহর কাছে হাত পাতবো। শুধু এইটুকু চাইবো যে আমি আর মিশু যেন একসাথে পাশাপাশি বসতে পারি। একসাথে পড়াশোনা করতে পারি। ওকে যেন বানিজ্য বা মানবিক শাখায় যেতে না হয়। ওকে সাইন্সই পড়তে হবে এবং তা একমাত্র আমার সাথেই আমার পাশে বসে। ফজরের নামাজ পড়ে তবজি গুনছি আর আল্লাহকে ডাকছি। আস্তে আস্তে দিন হয়ে গেলো। স্কুলে আমি আর আম্মু রেজাল্ট কার্ড আনতে গেলাম। স্কুলের অংক স্যারের হাত থেকে রেজাল্ট কার্ড নিলাম। ওয়াও, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছি না আমি তৃতীয় হয়েছি। এ যে আমার কল্পনার চেয়েও বেশী। যতটা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক অনেক বেশী। রেজাল্ট দেখে আম্মু আমার গালে আলতো করে চুমু খেল। আমার যে কি ভালো লাগছে তা বলে বুঝাতে পারবও না। কিন্তু... মিশুর কি হল? স্যার কে জিগ্যেস করলাম “ স্যার মিশু আসেনি? ওর রেজাল্ট কার্ড আনতে?”। স্যার বলল” ও তো অনেকক্ষণ আগেই রেজাল্ট কার্ড নিয়ে গেছে“ ।
আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে মিশুকে খুঁজছি। মিশু কই গেলো? রেজাল্ট পেয়ে তো ওর আমাকেই জানানোর কথা আগে। কিন্তু কি হল?? অনেক খুঁজেও মিশুকে পেলাম না। 

আম্মুকে বাসায় রেখে মিশুদের বাসায় গেলাম। ওদের বাসার সামনে এতো লোক কেন? কি হয়েছে ওদের বাসায়? ওদের বাসায় কি কোন অনুষ্ঠান? যতই অনুষ্ঠান থাকুক ওর তো আমার কাছে আসার কথা আগে। মিশু কি তাহলে আমার উপর কোন কারনে রাগ করেছে?? এমন তো হবার কথা না। ওদের বাসার সামনে গিয়ে দেখি একটা লাশ কাফনের কাপড় দিয়ে মোড়ানো । চারিদিকে আগরবাতির গন্ধ। ওর মার কিছু হল না তো? ওর মার তো অনেক অসুখ। কিন্তু ওর মা কে দেখলাম উনার খাটে শুয়ে কাঁদছে। ওর বোন ও কাঁদছে। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। তাহলে কি মিশু? মিশু বোকামি করে কিছু করে ফেলল না তো ? ও কেন এমন করবে? আমার পিঠে সোহাগের হাত। সোহাগ বলল” মিশু আর নেই রে দোস্ত। সে উঁচু পানির টাঙ্কির উপর উঠে নীচে লাফ দিয়েছে। ওর মাথার মগজ পুরো থেতলে গেছে। ওকে চেনাই যাচ্ছিল না” ।আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। পুরো চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। তারপর ... আমি জানি না কি করে আমি বাসায় এলাম। খাটে শুয়ে আছি। পাশে মা বসে আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আমি উঠে মা কে বললাম “ মা আমি এখানে কেমন করে এলাম? মিশু কই? আমি এখানে আসলাম কিভাবে? “।


মা বলল আমার এক বন্ধু আর তার বাবা আমাকে বাসায় দিয়ে গেছে। আমি মাকে ধরে অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম। মা বলল “ মিশুকে কবর দেয়া হয়ে গেছে রে শোনা। ওর মুখটাও তুই দেখতে পেলি না“ । মাও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মা ওকে নিজের ছেলের মতই ভালবাসত। আমাদের বাসায় এলে মিশু শুধু মার সাথেই কথা বলত। বাবা পুলিশ দেখে বাবাকে খুব ভয় পেত। আর ভাইয়ার কাছ থেকে মুখ লুকাতে আমার ঘরের জানালার পর্দায় মুখ লুকাত। ভাইয়া ঢাকায় বুয়েটে পড়তো। ছুটি পেলেই চলে যেত আমাদের সেই জেলা শহরের সরকারি বাসাতে।

 আজ আর সেই মিশু নেই। কিন্তু ও কেন মরলো? কেন তাঁকে মরতে হল?রাসেলের মুখ থেকে শুনেছি সে বার্ষিক পরীক্ষায় গড়ে ৭৯% নাম্বার পেয়েছিল। ওর ধর্ম পরীক্ষায় নাম্বার কম ছিল বলেই ওর গড় নাম্বার কমে গিয়েছিল। এই জন্যে ওকে মরে যেতে হবে? বার্ষিক পরীক্ষায় ধর্ম পরীক্ষার খাতা দেখেছিল আমাদের স্কুলে আসা এক নতুন স্যার। আমি নাহয় সাইন্স নাই পড়তাম। ওর সাথে বানিজ্য কিংবা মানবিক শাখায় পড়তাম। সবাইকে কি ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে নাকি? ও মরার আগে কি একবারও আমার মুখটি ভেবেছিল? ভাবলে হয়তো এভাবে আমাকে একা ফেলে মরতে পারতো না। মিশুর কবরের কাছে যেতে আমার ভীষণ ভয় করে। আমার স্কুলের সেই দুষ্টু ছেলেরাও খুব কেদেছে মিশুর জন্যে। 


সবাই ওর কবরের কাছে গেছে। শুধু আমিই যেতে সাহস পাই নি। কোনদিন যেতেও পারবও না ওর সামনে। ওকে তো আমি এভাবে দেখতে চাই নি। ও ছায়া হয়ে যেন আমার পাশেই ঘুরঘুর করছে। আমার বুকেই যেন মুখ লুকাচ্ছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমার জানালার পর্দায় মুখ লুকাচ্ছে আমার থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য। সেই পুতুল দুইটি আমি এখনো নিজের কাছে রেখে দিয়েছি। একটা পুতুল আমি আর একটা পুতুল আমার মিশু। ওকে আর দেয়া হল না। ওকে আর ছুঁয়ে দেখা হল না। 

রিলেটেড পোস্ট :



0 comments:

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

 
^ মাথায় ওঠ