blogger widgets

Monday 3 March 2014

নীল মানবঃ পর্ব - ০২

বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা অরণ্য যুবরাজ এর লেখা ধারাবাহিক গল্প 
_____________________________________________
অনেকক্ষণ হয়ে গেল ।
ইমন, নীল কেউ কারো সাথে কোন কথা বলছে না ।
দুজনের মাঝে নিরবতার জন্য বিরক্তি কিংবা পথের ক্লান্তি দায়ী নয় ।
বরং হালকা শীত শীত ভাব আর অর্থহীন এক ধরনের ভালো লাগা দুজনের মনে কাজ করছে ।
নীল কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছে । টের পায়নি সে ।
যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘণ্টা খানেক পেরিয়ে গেছে ।
বাইরে এখন ঝকঝকে রোদ ।
- কি ব্যাপার ! ঘুম ভাঙল ?
- হুম । কখন যে ঘুমালাম ! বুঝতে পারিনি ।
- সামনে কোথাও নামবেন ?
- বুঝলেন কি করে ! আমার যে খিদে পেয়েছে ?
- আরে নাহ ! আমি আসলে সেটা মিন করে বলিনি ।
ইমন হালকা লজ্জা পেল ।

দুজনে সামনেই একটা হোটেলে পেয়ে গেল ।
গাড়ি থেকে নামতেই নীল দৌড়ে গেল ।
হোটেলের সামনে ফুটে থাকা কতোগুলো গাঁদা ফুলের দিকে ।
ইমন একটা সিগারেট ধরিয়ে নীল এর দিকে তাকিয়ে আছে ।
নীল এর হাতে একটা বড়সড় গাঁদা ফুল ।
ও হাত দিয়ে ফুলটাকে এমন ভাবে আদর করছে মনে হচ্ছে ফুলটা একটা ছোট খরগোশ ।
- আপনি ফুল খুব ভালবাসেন ?
- হুম । আই লাভ ফ্লাওয়ারস ।
- সেতো দেখতেই পেলাম ।
- দেখার জন্য ধন্যবাদ । আজকাল দেখার মত চোখও সবার থাকে না ।
- কথায় আপনার সাথে পারা যাবে না ভাই ।
- থাক ইমন ভাই । আর কথা বলে কাজ নেই । খিদেতে আমার পেটে ইঁদুর দৌড়ুচ্ছে । কিছু খাওয়া দরকার ।



যে হোটেলটায় ওরা ঢুকল ওটা বেশ ছোট ।
বেশ নোংরা ।
চারপাশে মাছি ভন ভন করছে ।
যে ওয়েটার গুলো আছে তাদের কাঁধে ঝুলানো গামছা কতদিন ধুয় না কে জানে !
ইমন নীল এর দিকে তাকাল ।
- আপনি কি এখানে খেতে পারবেন ?
- কেন পারব না !
- না । হোটেল টা যে নোংরা ! তাই বললাম ।
- শুনুন, আমি কিন্তু ঢাকা ভার্সিটির হল লাইফ পার করে এসেছি । ইটালিয়ান হোটেল এ খাওয়ার অভ্যাসও আছে ।
- ইটালিয়ান হোটেল মানে ? ইমন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ।
- হা হা হা । আমাদের হল থেকে একটু দূরে এক মামা ভাত বিক্রি করত । সেখানে ইটের উপর বসে বসে লোকজন ভাত খেত । আমরা বন্ধুরা মজা করে মাঝে মাঝে সেখানেও খেতাম !
- বাহ ! আসলে ঢাকা ভার্সিটির হল লাইফ অনেক মজার । তাই না ?
- শুধু ঢাকা ভার্সিটি না , সব হল লাইফ দারুন এঞ্জয়েবল ।

একটা টেবিলে বসল ওরা দুজন ।
ইমন নীল দিকে তাকিয়ে বলল,
- কি খাবেন ? ব্যাঙ নাকি নাগিন ?
ইমনের কথায় নীল বেশ মজা পেল । ও দ্বিগুণ উৎসাহে বলল,
- ব্যাঙ আগে চেখে দেখেছি । এবার নাগিনের ভুনা হলে মন্দ হয় না !
ব্যাঙ অথবা নাগিন কিছুই পাওয়া গেল না ।
ওরা ভাত খেল মুরগি দিয়ে । কড়া ঝাল মশলা দেয়া ঝোল ।
এমন ঝাল যে দুজনের চোখ দিয়েই টপ টপ করে পানি বেরুচ্ছে ।
থেকে থেকে দুজনেই মুখ দিয়ে, জিভ দিয়ে ফুঁ দিচ্ছে ।

খাওয়া দাওয়া শেষে নীল বলল,
- আর হোটেল পেলেন না ভাই ! ঝালে আমার তালু পর্যন্ত জ্বলে যাচ্ছে ! 
- আপনারও জ্বলে নাকি । হা হা হা । চলুন যাওয়া যাক ।
নীল এবার আর কথা বাড়াল না ।
চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল ।

আধ ঘণ্টা পর গাড়ি হঠাৎ কোঁ কোঁ বিকট আওয়াজ দিল ।
থেমে গেল ।
- কি ব্যাপার ! ইমন ভাই । কোন সমস্যা ?
- কি জানি । বুঝত পারছি না । দেখি । কি অবস্থা গাড়ির । স্টার্ট নিচ্ছে না !
গাড়িটা যে জায়গায় নষ্ট হয়েছে তার একপাশেই ছোট একটা খালের মত চলে গেছে ।
এরপাশে উঁচু টিলা ।
নীল মনে মনে বলল, বাহ । দারুন জায়গা । ও ছোট বাচ্চাদের মত খালের দিকে ছুটে গেল ।
পানিতে ছোট ছোট মাছ । জল পোকা । ও ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ।
আর এদিকে ইমন গাড়ির বনেট খুলে কি নিয়ে যেন টানা টানি করছে ।
নীল এবার ইমনের দিকে ফিরে দূর হতে চেঁচিয়ে বলল,
- কি সমস্যা । কিছু বুঝতে পেরেছেন ?
- বুঝতে পারছি না ।
- গাড়ির কিছু বুঝেন ? গাড়ি কেন খারাপ হয় ? 
- ভাবছি, আপনার কাছ থেকে ট্রেনিং নিব ।

নীল চুপ মেরে গেল ।
ইমন কি একটু রেগে গেল !
- গাড়িটা ঠিক করতে পারছি না ।
- ও গড । এখন কি হবে ?
- কি আর হবে ? দেখি কি ব্যবস্থা করা যায় !

ভাগ্য ভালো কাছেই একটা গ্যারেজ পাওয়া গেল । গাড়ি মেরামত করার ।
কিন্তু এখানেও সমস্যা । যে গাড়ি ঠিকঠাক করে সে আজ নাই । পাশের গ্রামে গেছে । বেড়াতে ।
আসতে আসতে কাল সকাল ।
এসব শুনে নীলের মাথায় হাত !
- এখন কি হবে ?
- আপনি বারবার এই একটা বাক্য বলবেন না প্লিজ । এমনিতেই আমার মাথা গরম !
- সরি ।
- হুম । শুনুন, রাতটা আশে পাশের কোন বাড়িতে কাটাতে হবে ।
- কোথায় ?
- আমি এই গ্যারেজের মালিকের সাথে কথা বলেছি । উনি বলেছেন উনার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করবেন ।

------------------------------------------

গ্যারেজের মালিকের বাড়িতেই ওদের থাকতে হল শেষ পর্যন্ত ।
বাড়িতে দুটো ঘর ।
ওদের থাকার ঘরটা উঠোনের এক কোনায় । আলাদা ।
একচালা ঘর ।
বাড়িতে গ্যারেজের মালিক আর তার বউ থাকেন ।
এখন বউ নেই । বউ বাপের বাড়ি গেছে ।
ওদের ঘরের পেছনে অনেকগুলো কলাগাছ ।
ঘরে আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই ।একটা চকি । নতুন চাদর বিছানো । নেপথলিনের কড়া গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে ।
জানালার পাশ ঘেঁষে একটা টেবিল ।
তাতে সাদা ফুলতোলা নকশা করা কভার দেয়া ।
বিছানার পাশ ঘেঁষে দেয়ালে একটা হাতের কাজ এর নকশা করা রুমাল বাঁধানো ।
নীল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ।
নকশা করা রুমালটাতে দুইটা পাখি ।
আর মাঝখানে লেখা ‘ভুলনা আমায়’।
বিছানার দিকে তাকিয়েই নীল এর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ।
দুজন শোয়ার জন্য বড্ড ছোট ।

ইমন ঘরে ঢুকেই ধপ করে শুয়ে পড়ল ।
নীল কাঁধের ব্যাগ টেবিলে রেখে বাইরে বেরুল ।
মানুষটার কোন কাণ্ড জ্ঞান নাই ।
ঘরে ঢুকেই কোন কথা নাই, বার্তা নাই । বিছানায় ধপাস ।
চারদিকে আবছা আঁধার । ঝিঁঝিঁর ডাক, বয়ে যাওয়া নদীর শব্দ, নানারকম পোকার শব্দ !
নীল এর কেমন একটা মোহ মোহ ভাব লাগছে ।

- কি ব্যাপার ! আপনি ঘুমাবেন না !
পেছন থেকে ইমন জোর গলায় বলল ।
- ও আপনি ?
- ভয় পেলেন নাকি !
- আমাকে দেখে কি ভিতু মনে হয় ?
- আমি কি সেটা বলেছি ?
- আমার আজ ঠিক ঘুম আসছে না ।
- কেন ? বেশি টেনশন করছেন ?
- না । টেনশন না । ভালো লাগছে । এরকম পরিবেশে আমি কখনও থাকিনি ।
- মানুষ নিজেও জানে না তাকে কখন কোথায় কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় । তাই না !
- আমি আসলে এজন্য বলছি না ইমন । আসলে ছোটবেলা থেকেই অনেক জায়গায় ঘুরে বেরাতাম আমি । বাবার সাথে । বন্ধুদের সাথে । অনেক জায়গায় রাতে থেকেছি । কিন্তু আজকের রাতটা বড্ড বেশি আলাদা লাগছে । কেমন একটা মায়া মায়া ।
- বাহ বা । আপনি দেখছি এখন কবিতা বলা শুরু করবেন ?
- না সে ভয় পাবেন না ! কথায় কথায় কবিতা বলার অভ্যাস আমার নাই ! কবিতা আবেগের ব্যাপার ।
- কি জানি নীল । আমি আসলে এতটা বুঝে উঠতে পারি না । এসব আবেগ টাবেগ আমার কম । এসব আমার ধাঁতে নেই ।
- না থাকলেই ভালো । জীবনে কষ্ট কম পাবেন ।
- আমি কি একটা সিগারেট খেতে পারি ।
- আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন ?
- না । সিগারেট এর ধোঁয়ায় আপনার রাতের মায়ার যদি কোন ক্ষতি হয় ! তাই জিজ্ঞেস করলাম ।
- হা হা হা হা । মাঝে মাঝে আপনি অনেক রসিকতা করেন ইমন । তবে সিগারেট এর ধোঁয়ায় রাতের মায়ার ক্ষতির চাইতে আপনার গোলাপি হৃদয়ের ক্ষতি অনেক বেশিই হবে । তাই নয় কি ?
- ভাই । আমি আপনার সাথে তর্কে জিততে পারব না ।
ইমন হাত জোর করে বলল ।
এমন সময় আবার ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হল ।
ওরা দুজন দৌড়ে ঘরের ভেতর ঢুকল ।

_____________________________________________

ঘড়িতে এখন ১০ টা বাজে ।
চারদিকে শুধুই ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দ ।
ঠাণ্ডাও বেড়ে চলেছে ।
ইমন অনেক আগেই বিছানায় ঘুমিয়ে গেছে ।
নীল বসে আছে । চেয়ারে ।
হ্যারিকেন এর লালচে আলোর আবছা পরিবেশ ঘরজুড়ে ।
বিছানায় যেতে কেমন একটা সংকোচ হচ্ছে তার ।
নীল খুব ভালো করেই জানে সে সমপ্রেমী । তার উপর এমন একটা বৃষ্টির রাত ।
ইমন এর মত ভালোলাগার পুরুষের সাথে এক বিছানায়, এক কাঁথার নিচে শোয়া ।
নীল এক পা, দু পা করে এগুচ্ছে । বিছানার দিকে ।
রাত বাড়ছে । বাড়ছে বৃষ্টি । আর বাড়ছে নীল এর বুকের ধুক ধুক শব্দ ।

____________________________________________________________

(চলবে)

রিলেটেড পোস্ট :



0 comments:

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

 
^ মাথায় ওঠ